পররাষ্ট্রনীতিকে বৈচিত্র্যময় করতে ও ভারতনির্ভরতা কমাতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক জোট আসিয়ানে যোগ দিতে পারে বাংলাদেশ। কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের আসিয়ানে যোগ দেওয়াটা আপাতত সম্ভব নয়। বিশেষ করে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যখন বাংলাদেশ হিমশিম খাচ্ছে, তখন বিষয়টি খুব একটা সহজ হবে না। তবে কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন, আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সালিসের অভিজ্ঞতা ও এই অঞ্চলের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোটে বাংলাদেশের যোগদানের পক্ষে কাজ করতে পারে।
গত বুধবার বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান ন্যাশনস বা আসিয়ানের সদস্য হতে মালয়েশিয়ার সমর্থন চান। মালয়েশিয়া আগামী বছর আসিয়ানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাবে। ঢাকায় মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনাহ মো. হাশিমের সঙ্গে বৈঠকের সময় আসিয়ানের সদস্য হতে মালয়েশিয়ার সমর্থন চাওয়ার বিষয়টি উত্থাপন প্রধান উপদেষ্টা। হাইকমিশনার জানান, তিনি ড. ইউনূসের অনুরোধ তাঁর সরকারকে জানাবেন।
গত মাসের প্রথম দিকে ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশে আসেন ৮৪ বছর বয়সী নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গণতান্ত্রিক সংস্কার ও সংকট থাকা দেশের স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাঁর সামনে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসানে দেশে ফেরেন তিনি।
মালয়েশিয়ার প্যাসিফিক রিসার্চ সেন্টারের প্রধান উপদেষ্টা ওহ ই সান বলেন, ‘আসিয়ানের সদস্যপদ পেতে বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ার দ্বারস্থ হওয়া স্বাভাবিক। কারণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা মুসলিম এবং দেশটি ২০২৫ সালে আসিয়ান চেয়ার হতে চলেছে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আসিয়ানের সদস্য হওয়ার মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে আরও বেশি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আনতে আগ্রহী।’
সিঙ্গাপুর ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র এই ফেলোর মতে, ‘বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বেশির ভাগ আসিয়ান দেশ তার প্রতি সহানুভূতিশীল এবং দেশটির উন্নয়নের দুর্দান্ত সম্ভাবনা দেখে। তবে, কোনো আঞ্চলিক গোষ্ঠীর সদস্যপদ পাওয়ার জন্য বাস্তবসম্মতভাবে আবেদন করার আগে বাংলাদেশকে অবশ্যই রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিকভাবে আরও স্থিতিশীল হতে হবে।’
তবে আসিয়ানের সামনে মিয়ানমারের সংকটের মতো কিছু বিষয় আছে মাথা ঘামানোর। তাই বাংলাদেশের সদস্যপদ পাওয়াটা সহজ নাও হতে পারে। এ বিষয়ে ওহ ই সান বলেন, ‘মিয়ানমার সংকট এখনো চলছে। এই অবস্থায় আসিয়ান নিশ্চয়ই নতুন কোনো সদস্য নিতে চাইবে না যারা নিজেরাই এখনো অনেক সমস্যার মধ্যে আছে। তাড়াহুড়োর তো প্রশ্নই আসে না।’
এদিকে, তিমুর লেস্তের রাজধানী দিলিতে মালয়েশিয়ার দূতাবাসের এক বিবৃতিতে বলেছে, দেশটির প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস-হোর্তা আশা প্রকাশ করেছেন যে, তাঁর দেশ আগামী বছর আসিয়ানের সদস্য হবে। এই বিষয়টির সঙ্গে আরেকটু যোগ করে ওহ বলেন, বাংলাদেশ ও আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্বও জোটে যোগদানে ঢাকার পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
মিয়ানমারে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের অভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশটিকে নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত জোটটি। জোটের বেশ কিছু সদস্য দেশ—ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর মিয়ানমারের জান্তার শাসন নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছে। বিপরীতে থাইল্যান্ড সরাসরি জান্তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে পিএইচডিরত ইশরাত হোসেন বলেন, ‘জোটের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ফোকাসের কারণে বাংলাদেশের আসিয়ানের পূর্ণ সদস্য হওয়ার সম্ভাবনা কম।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য আসিয়ানের সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল। কারণ, ঢাকা এর আগে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ইস্যুতে যুক্ত হওয়ার মতো বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।’ তাঁর মতে, আসিয়ানে যোগদানে বাংলাদেশের পরিকল্পনা হাসিনার ‘ভারতকেন্দ্রিক পররাষ্ট্র নীতি’ থেকে দূরে সরে গিয়ে পূর্বের প্রতিবেশীদের প্রতি আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে।
হাসিনা তাঁর শাসনামলে ভারতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। জুলাই মাসে নয়া দিল্লি সফরের সময় তাঁর প্রশাসন মেরিটাইম সহযোগিতা, ডিজিটাল অংশীদারত্ব এবং মহাকাশ প্রযুক্তি থেকে রেল সংযোগের মতো বিষয়ে ১০টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ফেয়ারব্যাংক সেন্টার ফর চাইনিজ স্টাডিজের অনাবাসিক ফেলো অণু আনোয়ার বলেন, ‘ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের সময় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রতি ক্ষোভও আসিয়ানের সদস্য হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে প্ররোচিত করেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটি আংশিকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বিষয়ে ভারতের অপ্রতিরোধ্য হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দ্বারা অনুপ্রাণিত। সেই বিবেচনায় ঢাকা ভারতের প্রভাব প্রশমিত করার এবং বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করার একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আসিয়ানে সদস্যপদ পাওয়ার বিষয়টিকে দেখছে।’
অনেক বাংলাদেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক শেখ হাসিনা ও তাঁর প্রশাসনের বিরুদ্ধে দেশের সর্বশেষ তিনটি সাধারণ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনেছেন। যার সর্বশেষ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি। এ সময় ২৫ হাজারেরও বেশি বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীকে কারাগারে বন্দী করা হয়েছিল। তবে ভারত এই নির্বাচনের ফলাফলকে স্বাগত জানায়। প্রতিক্রিয়ায় অনেক বাংলাদেশিকে ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারাভিযান শুরু করে। তাদের অভিযোগ, নয়া দিল্লি তার স্বার্থ রক্ষায় হাসিনাকে সমর্থন করছে চোখ বন্ধ করে।
অণু বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর হাজার হাজার মানুষ দক্ষিণ বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার চলমান সংকট আসিয়ানের সদস্যপদ পেতে ঢাকার আগ্রহকে যৌক্তিকতা দেয়। বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের মতে, মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধেও বিগত কয়েক মাসে প্রায় ৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।
এই বিষয়টি ছাড়াও আসিয়ান ও বাংলাদেশ মাদক ও মানব পাচারের মতো সাধারণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় হাত মেলাতে পারে কলে মনে করেন অণু। তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল অব দ্য সি (ইটলস)—এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা আসিয়ান সদস্যদের মূল্যবান দক্ষতা প্রদান করতে পারে।’
আন্তর্জাতিক এই আদালত ২০১৪ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সমুদ্রসীমার সীমানা নির্ধারণ নিয়ে একটি মামলায় ঢাকার পক্ষে রায় দেয়। ২০১২ সালে বাংলাদেশ ইটলসে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা জেতে। যার ফলে মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইল বিস্তৃত অর্থনৈতিক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারায়। আসিয়ানের সদস্য দেশ মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ব্রুনাই ও ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ চীন সাগরে অঞ্চল, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সম্পদ অনুসন্ধান নিয়ে চীনের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী বিরোধে আবদ্ধ। যেখানে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগতে পারে।
অণু আনোয়ার বলেন, ‘তাই, কৌশলগত অবস্থান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগের কারণে আসিয়ানে বাংলাদেশের সম্ভাব্য একীকরণ সম্ভব। যেহেতু এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে তাই আসিয়ানের স্বার্থ এবং চ্যালেঞ্জের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থ ও চ্যালেঞ্জ মিলে যাওয়াও সদস্যপদ পাওয়ার জন্য ঢাকা আগ্রহকে ন্যায্যতা দিতে পারে।’