দেশে দুই বছর ধরে চলছে আর্থিক সংকট। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার। এ কারণে অনেকেই ব্যাংক থেকে আমানত তুলে সংসার চালাচ্ছেন। তবে ব্যতিক্রম কোটিপতিরা। গত তিন মাসে দেশে কোটিপতির সংখ্যা কমলেও তাদের হিসাবে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত মার্চে দেশের ব্যাংক খাতে কোটিপতি অ্যাকাউন্ট ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৮৯০টি। এসব হিসাবে জমার পরিমাণ ৮ লাখ ১০ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির হিসাব ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ৯০৮টি। ওই হিসাবগুলোতে জমার পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৪১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। অর্থাৎ, তিন মাসের ব্যবধানে কোটিপতিদের ১ হাজার ১৪টি অ্যাকাউন্ট কমলেও আমানত বেড়েছে ৬৯ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা।
তথ্য বলছে, সাধারণত যেসব ব্যাংক হিসাবে আমানতের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকার কম, সেগুলোকে নিম্নবিত্তের হিসাব ধরা হয়। সাধারণত এগুলো ১০, ৫০ ও ১০০ টাকায় খোলা হিসাব। ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকার হিসাবগুলোকে মধ্যবিত্ত, ৫ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত উচ্চ মধ্যবিত্ত বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং ১ কোটি থেকে ওপরের আমানতের হিসাবগুলোকে ধনী শ্রেণি বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের আমানত বিবেচনা করা হয়।
চলতি বছরের মার্চে ব্যবসায়ী বা ধনী শ্রেণির আমানত হিসাবে ৬৯ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা বাড়লেও সার্বিকভাবে ব্যাংকে আমানত বেড়েছে মাত্র ১৩ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত আমানতকারীদের ব্যাংক হিসাব থেকে জানুয়ারি-মার্চ সময়ে আমানত কমেছে ৫৬ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ যখন দিশেহারা, তখন এক শ্রেণির মানুষের অর্থবৃদ্ধি দেশে আয়বৈষম্য বাড়ার বহিঃপ্রকাশ। তাদের মতে, করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আশঙ্কাজনক হারে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে; কিন্তু সে অনুযায়ী মানুষের আয় বাড়েনি। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ অবস্থায় অর্থ জমানো দূরের কথা, অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। এই সময় দেশের এক শ্রেণির মানুষের আয় বেড়েছে। তারা পুঁজিপতি, বিত্তবান ও বড় বড় প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। তাদের আয় আগেও বেশি ছিল, এখন আরও বেড়েছে। মূলত আয়বৈষম্যের কারণেই দেশের কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে।
মার্চ শেষে ৫ টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকার হিসাবে (নিম্নবিত্ত) ৪৭ হাজার ২২৫ কোটি, ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকার হিসাবে (মধ্যবিত্ত) ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা এবং ৫ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার হিসাবে (উচ্চমধ্যবিত্ত) ৬ লাখ ২২ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, দেশের কোটিপতির সংখ্যা কমছে; কিন্তু কোটিপতিদের অ্যাকাউন্টে আমানত বাড়ছে। এটা দেশের আয়বৈষম্যের প্রমাণ। অর্থাৎ দেশে অল্প কিছু লোকের কাছে টাকা বা অর্থ গিয়ে পুঞ্জীভূত হচ্ছে। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের হুমকি। কিন্তু শাসক দল বিষয়টির দিকে নজর দিচ্ছে না। এটা খুবই হতাশজনক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিলেন ৫ জন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এরপর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪টি, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭টি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে তা এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টিতে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে কোটিপতির হিসাব দাঁড়ায় ১ লাখ ১ হাজার ৯৭৬টি।